প্রত্যয় নিউজ ডেস্ক: ভোরে শিশির সিক্ত ঘাস। দৃষ্টির খুব কাছেই কুয়াশার রেখা। সূর্যের আলোতে ক্রমেই ম্লান হচ্ছে কুয়াশার আভা। হঠাৎ উত্তরের শিরশিরে হাওয়ার ঝাঁকুনি। প্রকৃতি এভাবেই শীতের আগমনী বার্তা জানান দিচ্ছে। বছরের এই সময়টাতে নৈসর্গের আরেক নাম হয়ে ওঠে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসে লাল শাপলায় রক্তিম শোভিত জলাশয়ে আগমন ঘটে ভিনদেশী পাখির।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীশূন্য ক্যাম্পাস এখন নীরব-নিস্তব্ধ। তবে পরিযায়ী পাখির আগমনে যেন নতুন করে প্রাণ পেতে শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
রাজধানীর অদূরে বন্ধুর ও সমতল ভূমিতে গড়ে ওঠা এ ক্যাম্পাসে শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে পাখির সংখ্যা। লেকের জলে পাখিদের ভেসে বেড়ানো আর জলকেলির দৃশ্য যে কারও দৃষ্টি জুড়াবে। খুঁনসুটি আর ছোটাছুটিতে পাখিরা দিনভর মাতিয়ে রাখে বিশ্ববিদ্যালয়ের জল, স্থল আর আকাশ।
এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনের লেক, ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের ভেতরের লেক, ট্রান্সপোর্ট সংলগ্ন লেকসহ সুইমিংপুল সংলগ্ন জয়পাড়া লেকে আশ্রয় করে নিয়েছে তারা।
দেশীয় জাতের পাশাপাশি বিদেশি হাঁসজাতীয় এসব পাখি বরফ শুভ্র হিমালয় ও সুদূর সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে আসে। এরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু সময় কাটিয়ে পরে আবার ফিরে যায় নিজ দেশে। তাই এদের বলা হয় অতিথি পাখি। মূলত নিজ অঞ্চলের তীব্র শীত থেকে বাঁচতে প্রতিবছরই বাংলাদেশের মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে উড়ে আসে অতিথি পাখিরা।
এই পাখিদের মধ্যে রয়েছে- সরালি, গার্গেনি, পিচার্ড, মানিকজোড়, মুরগ্যাধি, জলপিপি, নাকতা, কলাই, ফ্লাইপেচার, পাতারি, চিতা টুপি, লাল গুরগুটিসহ নানা প্রজাতি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬ সালে এখানে প্রথম অতিথি পাখি আসা শুরু করে। এসব পাখির মধ্যে ১২৬টি দেশীয় ও ৬৯টি বিদেশি প্রজাতি মিলিয়ে মোট ১৯৫ প্রজাতির পাখি রয়েছে। অতিথি পাখিরা অক্টোবরের শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জলাশয়ের আশপাশে আশ্রয় নিতে শুরু করে। আর ডিসেম্বরের দিকে তা পরিপূর্ণ রূপ পায়।
প্রজাতি ও পাখির সংখ্যা বেড়েছে
সাধারণত নভেম্বর মাসের শুরুতে পাখি আসতে শুরু করলেও এবার একটু আগেভাগেই পাখি এসেছে। এবার সেপ্টেম্বর মাসেই পাখি আসতে শুরু করে। সেই সঙ্গে এবার বেড়েছে পাখির সংখ্যা ও প্রজাতি।
গত বছরের ডিসেম্বরে পাখি শুমারিতে ক্যাম্পাসে ৫ হাজারের কিছু বেশি পাখি এসেছিল বলে রেকর্ড করা হয়। তবে এবার শুরুতেই ৫ হাজারের মতো পাখি এসেছে বলে প্রাথমিক শুমারিতে জানা গেছে।
একইসঙ্গে গতবছর ৫ প্রজাতির পাখির আগমন ঘটেছিল। তবে এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টি লেকে ৭ প্রজাতির পাখি এসেছে।
প্রজাতিগুলো হলো- নাকতা হাঁস, খুনতে হাঁস, জিরিয়া হাঁস, ভুতি হাঁস, লেঞ্জা হাঁস, আফ্রিকান কম্বডাক, ছোট সরালি ও বড় সরালি। এর মধ্যে ছোট সরালি দেশের হাওর অঞ্চল থেকে আসে। সাইবেরিয়া, নেপাল, চীন, ভারতের আসাম, অরুনাচল অঞ্চল থেকে আসে বড় সরালি জাতের পাখিরা।
গত ৮-৯ নভেম্বর প্রাথমিকভাবে পাখির ওপর শুমারি করা হয় বলে জানান পাখি বিশেষজ্ঞ ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান।
তিনি বলেন, এবার অন্যবারের থেকে বেশি সংখ্যক পাখি আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সাধারণত ডিসেম্বরে সবচেয়ে বেশি পাখি আসে। তবে বিগত বছরগুলোতে ডিসেম্বরে যে পরিমাণ পাখি এসেছিল এবার নভেম্বরেই আমরা সেই সংখ্যক পাখি দেখতে পেয়েছি।
মানুষের ভিড় যেখানে, পাখিদের ভয় সেখানে
ট্রান্সপোর্ট ও প্রশাসনিক ভবন সংলগ্ন দুই লেকের পাশ দিয়ে চলে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সড়ক। আর এই রাস্তার পাশ থেকে সহজেই পাখি দেখা যায়। যে কারণে দর্শনার্থীর ভিড় এই দুই লেকের পাশেই বেশি লক্ষ্য করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য দুই লেকের সর্বত্র পাখির বিচরণ লক্ষ্য করা গেলেও এই দুই লেকে তার ব্যতিক্রম। এই দুই লেকে শুধু একপাশেই পাখিদের অবস্থান করতে দেখা যায়। রাস্তা ও জনসমাগমের ঠিক বিপরীত দিকে পাখিরা অবস্থান করে।
মানুষের উৎপাত, গাড়ির আওয়াজ ও আবর্জনার কারণে পাখিরা দূরে থাকে বলে জানান পাখি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পাখিরা মানুষ দেখে ভয় পায়। তাই তাদের থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। অনেকসময় অসচেতন হয়ে মানুষ পাখি দেখতে নির্দিষ্ট বেড়া অতিক্রম করে কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে। এতে পাখিদের অবাধ বিচরণ ব্যহত হয়।
এছাড়া রাস্তার পাশে হওয়ায় অনেকেই এসব লেকে প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন ইত্যাদি ফেলে দেন। এর ফলে সেখানখার পরিবেশ দূষিত হয়।
দর্শনার্থী প্রবেশে না
করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় বহিরাগত প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কর্তৃপক্ষ। ফলে অন্যান্য বছরের মতো এবার ক্যাম্পাসে পাখি দেখা হচ্ছে না শৌখিন দর্শনার্থীদের।
তবে নিষেধাজ্ঞা ভেঙে অনেকেই প্রবেশ করছে ক্যাম্পাসে। এতে ক্যাম্পাসবাসীর করোনার ঝুঁকি বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাখিদের প্রতিও মানুষের উৎপাত বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ জাগো নিউজকে বলেন, ক্যাম্পাসে বহিরাগত প্রবেশ বন্ধে প্রশাসন অত্যন্ত তৎপর। তবে মানুষের অসচেতনতা ও অসহযোগিতার কারণে তা সম্পূর্ণভাবে সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা নানাক্ষেত্রে বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে। পাখি সংরক্ষণে প্রতিবছরের মতো এবারও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
পাখি মেলার সম্ভাবনা কম
পাখি সংরক্ষণ ও এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে পাখি মেলার আয়োজন করে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ। ২০০১ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে পাখিমেলা হয়ে আসছে। তবে এবার করোনাভাইরাসের কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় পাখি মেলা হওয়ার সম্ভাবনা কম।
গত বারের পাখি মেলার আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান বলেন, ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলে এবার পাখি মেলা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পাখি থাকাকালে ক্যাম্পাস খুললে মেলা হতে পারে।